চট্টগ্রাম বুলেটিন

জেল মুক্তির পর ছোট সাজ্জাদ গ্রুপের নেতৃত্বে শীর্ষ সন্ত্রাসী সবুজ, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

নগরের বায়েজিদ বোস্তামী, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, খুলশী থানা এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ৩৫টি মামলার আসামি, বহিস্কৃত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মো. সবুজ ওরফে বার্মা সবুজ এবার জামিন পেয়ে জেল থেকে মুক্তির আগেই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। অভিযোগ ওঠেছে, তার জামিনের দিন গত ৪ ডিসেম্বরই নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় দুই কাস্টমস কর্মকর্তার উপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা তার ইন্ধনেই হয়েছে। এতে অংশ নেওয়া সন্ত্রাসীরা তারই সহযোগী। হামলার সময় রাজস্ব কর্মকর্তাদের ‍উপর গুলি করারও নির্দেশ দেন হামলকারীদের একজন। পুলিশ এ ঘটনায় গতকাল রাতে বান্দরবানে অভিযান চালিয়ে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতা পাঁচলাইশ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের বহিস্কৃত নেতা শীর্ষ সন্ত্রাসী বার্মা সবুজসহ অপর এক হামলকারী।

গ্রেপ্তাররা হলেন, কাজী ইমন হোসেন (২৩) ও মো. সুজন (২৪)। তারা দুজনই শীর্ষ সন্ত্রাসী বহিস্কৃত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মো. সবুজ ওরফে বার্মা সবুজের অনুসারী।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে ছোট সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী তামান্নার চারটি হত্যা মামলায় জামিন, সিএমপির তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মো. সবুজ ওরফে বার্মা সবুজের জামিনসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের বেরিয়ে আসা নিরাপত্তার জন্য হুমকির। ঢাকায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদীর উপর গুলি, মিরসরাইয়ে জুলাই যোদ্ধা তাহমিদ হত্যা, চট্টগ্রামে বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহকে গুলি ও সন্ত্রাসী সরোয়ার বাবলকে হত্যাই বলে দেয় ফের এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে নগরে। এসব সন্ত্রাসী কারাগারের বাইরে থাকলে প্রার্থী থেকে ভোটার কেউ নিরাপদ নয়। যেকোন মুহুর্তে ভাড়া খেটে তারা খুনের ঘটনা ঘটাতে পারে বলেও মনের অপরাধ বিশ্লেষকরা।

এর আগে গত ৪ ডিসেম্বর সকাল দশটায় কাস্টমস কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান খান ও বদরুল আরেফিন ভূঁইয়্যাকে বহনকারী একটি প্রাইভেটকার আটকে হামলা করা হয়। এতে কোনমতে প্রাণে বাঁচেন দৃুই রাজস্ব কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান খান ও বদরুল আরেফিন ভূঁইয়্যা। এসময় তাদের গাড়ির গ্লাসে চাপাতি দিয়ে কোপ দেওয়া হয় এবং দরজায় লাথি মারা হয়। পরে এক যুবককে গুলি কর, গুলি কর, বলে চিৎকার করতে শোনা যায়। এসময় একটি মোটরসাইকেলে তিনজন পালিয়ে যায়। পাশে আরও একটি মোটরসাইকেলও দেখা যায়। এ সংক্রান্ত ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, হামলায় মোট ছয়জন অংশ নেন। তারা তিনটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। তারা সবাই শীর্ষ সন্ত্রাসী মো. সবুজ ওরফে বার্মা সবুজের অনুসারী।

অভিযোগ ওঠেছে, ইতিমধ্যে হামলায় অংশ নেওয়া সোহাগকে বাইরে নিরাপদে সরিয়ে দিয়েছেন বার্মা সবুজ। গত ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কর্মকর্তারা অজ্ঞাতনামা তিনজনকে আসামি করে নগরের ডবলমুরিং থানায় মামলা করেছেন। কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান খান মামলায় বাদী হন। মামলায় বলা হয়, রাজস্ব কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বদরুল আরেফিন ভূঁইয়্যা ৪ ডিসেম্বর সকালে কাস্টমস হাউজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। এসময় আগ্রাবাদ সিডিএ ১ নম্বর রোড়ে একটি মোটরসাইকেল থেকে নেমে তাদের প্রাইভেটকারের গতিরোধ করা হয়। তাদের মধ্যে দুইজন হেলমেট পরিহিত একজন হেলমেট বিহীন যুবক ছিলেন। একপর্যায়ে চাপাতি দিয়ে গাড়িতে আঘাত করা হয় এবং গুলি কর, গুলি কর বলে চিৎকার করতে থাকেন সন্ত্রাসীদের একজন। মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, গত ৫ অক্টোবর একটি নম্বর থেকে ফোন করে সাজ্জাদ পরিচয়ে হুমকি দেওয়া হয়।

কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, আমদানি নিষিদ্ধ পপি বীজ ও ঘনচিনি, নিষিদ্ধ কসমেটিকসসহ একাধিক অবৈধ ‍চালান তারা আটক করেছে। এসব ঘটনায় হামলার শিকার দুই রাজস্ব কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এতে অনেকে তাদেরকে টার্গেট করে হামলা করতে পারেন। এ ঘটনায় কাস্টমস কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় আছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। ধারণা করা হচ্ছে, চোরকারবারীরা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে কাস্টমস কর্মকর্তাদের হত্যা করতে চেয়েছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৯ জুন শীর্ষ সন্ত্রাসী বার্মা সবুজ বায়েজিদের হিলভিউ কলোনী থেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই থেকে তিনি পাঁচ মাস ধরে কারাগারে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, হত্যা, চাঁদাবাজি, হামলাসহ ৩৫টির বেশি মামলা রয়েছে।

গত ৫ ডিসেম্বর তিনি জামিন পেয়ে জেল থেকে মুক্তি পান। তার আগেই কারাগারে তার সাথে শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ ওরফে ছোট সাজ্জাদের সাথে ডিল হয়। বর্তমানে সাজ্জাদের হয়ে বার্মা সবুজ কাজ করছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এমনকি শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের অনুসারীরা তার দলে যোগ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, কাস্টমস কর্মকর্তাদেরকে ফোনে সাজ্জাদের নামে দেওয়া হুমকিও বার্মা সবুজের লোকজন দিয়েছেন। হামলায় সন্ত্রাসী বার্মা সবুজের অনুসারী সন্ত্রাসী সোহাগ, সুজন, রিয়াদ, ইমন, ইউসুফ ও সরোয়ার বাবলা হত্যার আসামি হৃদয়সহ মোট ছয়জন তিনটি মোটরসাইকেলে অংশ নেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে সুজন ও ইমন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিরা এখনও পলাতক। সন্ত্রাসী ইউসুফ সবুজের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবন থেকে চাঁদা আদায় ও অস্ত্র হস্তান্তর তার প্রধান কাজ। সম্প্রতি ভিডিও বার্তা দিয়ে তিনি সবুজের সাথে কাজ করার কথা পুনব্যক্ত করেন। এছাড়া হামলায় অংশ নেওয়া অন্যদের সাথেও বার্মা সবুজের ঘনিষ্ঠ ছবিও রয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে সন্ত্রাসী ইউসুফ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের অনুসারী ছিলেন। এছাড়াও তার সাথে থাকা বেশিরভাগ সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক চসিক কাউন্সিলর মোবারক আলীর অনুসারী ছিলেন।

গত বছরের নভেম্বরে বার্মা সবুজকে গ্রেপ্তার করা হলেও কিছুদিন কারাগারে থেকে পুনরায় জামিনে এসে অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন তিনি। এবারও জামিন এসে অপরাধে জড়ান সবুজ। একই বছরের অক্টোবরে তাকে পাঁচলাইশ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ থেকে বহিস্কার করা হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৭ জুন বায়েজিদ এলাকায় ইউসুফ নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে দলবলসহ অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় বার্মা সবুজ। এসময় ভাঙচুর করে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরে ইউসুফের মামলায় পুলিশ তাকেসহ তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে।

নগর পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার (জনসংযোগ) আমিনুর রশিদ জানান, কাস্টমস কর্মকর্তাদের উপর হামলার ঘটনায় দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা মূল হোতাকে চিহ্নিত করেছি। সুনির্দিষ্টভাবে এখন কিছু বলতে পারছি না।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ডেপুটি কমিশনার মো. তারেক মাহমুদ জানান, আমরা সত্যিকার অর্থে উদ্বিগ্ন। জড়িত সব আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে পারলেই আমরা মনে করব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের নিরাপত্তা দিতে পেরেছে। অন্যথায় দেশের জন্য কাজ করতে কমিশনাররা উৎসাহিত হবেন না। তারা মানসিকভাবে যেন ভেঙে না পড়েন সেটাই আমরা চাই। আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যে আমদানি আটকে দেওয়া ও কয়েকটি চালান আটকের ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে চোরাকারবারীরা এসব করছে।

Tags :

সর্বশেষ