চট্টগ্রাম বুলেটিন

মনোনয়ন দিয়ে সীতাকুণ্ড বিএনপিতে প্রকাশ্যে এলো গ্রুপিং, পদ হারাচ্ছেন আসলাম ঘনিষ্টরা  

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড-পাহাড়তলী-আকবরাশাহ আংশিক) আসনের বিএনপির মনোনয়ন কাজী সালাউদ্দিনের কাছে যাওয়ার পর থেকে এই উপজেলায় দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন পানির মতো স্পষ্ট। এতোদিন ভেতরে ভেতরে কোন্দল চললেও গত ৩ নভেম্বরের পর থেকে প্রকাশ্যে আসে কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন গ্রুপ। এর আগে লায়ন অধ্যাপক আসলাম চৌধুরীই ছিলেন এই আসনের একক নেতা। তাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার মতো কোন নেতা এখনও এখানে সৃষ্টি হয়নি বলে মনে করেন রাজনৈতিক সচেতন মহল।

সর্বশেষ ৭ ই নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবসে কাজী সালাউদ্দিন ও আসলাম চৌধুরী প্রথমবারের মতো আলাদা কর্মসূচী পালন করেন। এর আগে পৃথক কর্মসূচী কখনই পালন করেননি এখানকার বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতারা। বলা চলে মনোনয়ন ঘিরেই এখানে গ্রুপিং রাজনীতি এখন তুঙ্গে ওঠেছে।

গত শুক্রবার সীতাকুণ্ড বাজারে বিশাল শোডাউন করে উত্তর জেলা বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। এতে কয়েক হাজার নেতাকর্মী অংশ নেন। তবে দলের বিতর্কিত অনেক নেতা, বহু মামলার আসামি ও আওয়ামী লীগ, যুবলীগের কর্মীদেরও দেখা গেছে তার মিছিলে। তাছাড়া নেতাকর্মীদের অনেকেই অভিযোগ করেন মিরসরাই থেকে লোক এনে সমাবেশ পুরিয়েছেন কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। অন্যদিকে আসলাম চৌধুরী একইদিন বাড়বুকণ্ডে হাইস্কুল মাঠে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে। এখানেও হাজার হাজার নেতাকর্মী অংশ নেন।

তবে মনোনয়ন ঘোষণার দিন গত ৩ নভেম্বর আসলাম চৌধুরীর পক্ষে মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে নেতাকর্মীরা। এদিন টানা সাত ঘন্টা মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রাখে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। পরে মধ্য রাতে তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ের চার নেতাকে বহিস্কার করা হয়। তারা হলেন— উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আলাউদ্দিন মনি, সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন, পৌর বিএনপির আহ্বায়ক মো. মামুন এবং সোনাইছড়ি ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোমিন উদ্দিন। এ চারজন আসলাম চৌধুরীর অনুসারী বলে স্থানীয় দলীয় সূত্র জানায়।

এরপর থেকে একের পর এক আসলাম অনুসারীদের শাস্তি দিচ্ছে কেন্দ্র। গতকাল আবারও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. কমল কদর, উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মোরসালিন ও উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য সচিব কোরবান আলী সাহেদের সব পদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিক রুহুল কবির রিজভী সাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, তাদেরকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য পদ স্থগিত করা হয়েছে।

 

ষড়যন্ত্রের শিকার আসলাম চৌধুরী:

দলীয় বিশ্লেষকরা জানান, আসলাম চৌধরী একজন ত্যাগী নেতা। তিনি সাড়ে আট বছর জেলে ছিলেন। শতাধিক মামলায় তিনি স্বৈরাচার আমলে পুরো সময়জুড়েই কারাগারে কাটান। কারাগারে নেতাকর্মীদের নানাভাবে পাশে ছিলেন এই নেতা। এছাড়াও ২৪ এর ৫ আগস্টের পর কারা বিদ্রোহ ঠেকিয়েও প্রশংসিত হন তিনি। তিনি নানা ধরণের সামাজিক কার্যক্রমের জন্য যেমনি আলোচিত তিনি ব্যবসায়ী হিসেবেও সফল। তিনি লায়ন জেলা ৩১৫বি৪ এর সাবেক গভর্ণর। কিন্তু হাসিনা তাকে টার্গেট করে সীতাকুণ্ডের ২০১৩-১৪ সালের আন্দোলনের জন্য। মোসাদের এজেন্ট নাটক সাজিয়ে তাকে সরকার পতনের ষড়যন্ত্রে দায়ী করা হয়। বহু নেতা জেল থেকে বের হলেও তাকে শেষ পর্যন্ত জামিন দেননি হাসিনা। কিন্তু এতো ত্যাগী নেতাকেও মনোয়নন দেয়নি দল। শুধু তাই নয়, বর্তমানে তিনি কয়েকজন নেতার ষড়যন্ত্রের শিকার বলে দলের একটি সূত্র জানিয়েছে। তাকে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে ওইসব নেতারা। ফলে মনোনয়ন না চাওয়া একজনকে এনে মনোনয়ন দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

উপজেলা বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা বলেন, কোনদিন সীতাকুণ্ডে গ্রুপিং ছিল না। আসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। তার অসাধারণ নেতৃত্বের প্রতি সবাই মুগ্ধ। যেদিন তিনি জামিনে আসেন জেল থেকে সেদিনও তার গাড়ি ধরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঝুলে ছিলেন কাজী সালাউদ্দিন। অথচ আজ তার নেতৃত্বেই গ্রুপিং হলো। এটা আমরা কখনও কল্পনা করিনি।

উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব জহুরুল আলম জহুর বলেন, আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দিয়ে কেন্দ্র ভুল ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছে। তৃণমূল ইতিমধ্যে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আসলাম চৌধুরী জেলে থেকে দুই ভাইকে হারিয়েছেন। তার ভাই যখন মারা যান তখন তাকে প্যারুলে মুক্ত করতে চাইলেও স্বৈরাচার সরকার তাও দেয়নি। শেষবারের মতো আপন দুই ভাইকে দেখা হয়নি। নিজের মেয়ের বড় হওয়াটাই দেখেননি। শতকোটি টাকার ব্যবসা ধ্বংস করে দিয়ে তাকে বানানো হয়েছে ঋণখেলাপী। অথচ তার শৈল্পিক গুণ, ব্যবসায়িক সাফল্য আড়াল করা হয়েছে। তিনি অত্যন্ত ডায়নামিক ব্যক্তিত্ব। তিনি বহু গুণের অধিকারী রাজনিতিবিদ।

উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমল কদর বলেন, আমরা আসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কাজ করছি। তিনি ঢাকায় গিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাকে মনোনয়ন দেওয়ার আশ্বাসও পেয়েছেন। তারপরও আমাদের পদ স্থগিত করা হয়েছে।

 

বহিস্কারকে চ্যালেঞ্জ তৃণমূলের:

আসলাম চৌধুরীর জন্য কাজ করা ও প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন পাওয়া কাজী সালাউদ্দিনের জন্য কাজ না করায় কেন্দ্রে তথ্য পাঠাচ্ছেন কাজী সালাউদ্দিন এমনটাই মনে করেন সীতাকুণ্ডের বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে বহিস্কারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তারা বলছেন, আসলাম চৌধুরীর জন্য হাজার হাজার নেতাকর্মী বহিস্কার হতে প্রস্তুত আছেন। তারা আসলাম চৌধুরীর আবিস্কার, ডরে না তারা বহিস্কার এমন স্লোগানও দিচ্ছেন। অবিলম্বে মনোনয়ন পরিবর্তন করে আসলাম চৌধুরীকে দেওয়ার দাবি জানান তারা। সম্প্রতি কয়েকশো নেতাকর্মী ফেসবুকে পোষ্ট করেন, তারা বহিস্কার হতে প্রস্তুত।

উত্তাল সামাজিক মাধ্যম 

 

সীতাকুণ্ডে এখন বিএনপির দুটি গ্রুপে সামাজিক মাধ্যমেও উত্তালও। কেউ কেউ কড়া মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছেন প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে। আর কেউবা দিচ্ছেন পোষ্টও। এমনকি আসলাম চৌধুরীর জন্য কাঁদতেও দেখা গেছে কয়েকজনকে। তারা কিছুতেই তার অবদান ভুলে যাবেন না বলে জানিয়ে দেন।

এদিকে আসলাম চৌধুরী ঢাকা থেকে সভা করে আসেন। তার আগে মনোনয়ন পাল্টে গেছে বলে সামাজিক মাধ্যমে ঝড় ওঠে। অনেকেই লিখেন, সুখবর, মনোনয়ন আসলাম চৌধুরীই পাবেন। ঢাকা থেকে এসে দুটি পৃথক কর্মসূচীতে ঘোষণা দেন ‍ধানের শীষ আমাদেরই থাকবে। আমারই থাকবে। এর আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, দলের যেই বা যিনি মূল্যায়ন করবেন তাকে অবশ্যই তৃণমূলের পালস বুঝতে হবে। তা না হলে শেষে ফলাফল কি হবে তা দেখতে হবে। জনগণের প্রত্যাশার মূল্য যদি কেউ না দেয়, যদি তারা বেঈমানী করে তাহলে জনগণ এর জবাব দেবে। আর জন আখাঙ্কার বাইরে কিছু হলে প্রতিক্রিয়া আসবে, এটা স্বাভাবিক। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে বা আরও পরে হলেও মহান আল্লাহ আমাকে সুস্থ রাখলে আমি অংশ নেব এটা সুনিশ্চিত।

অপরদিকে কাজী সালাউদ্দিন শুক্রবার ৭ ই নভেম্বর করা শোডাউনে তার বক্তব্যে বলেন, আমি আসমান থেকে ভেসে আসিনি। আমিও তৃণমূল থেকে ওঠে এসেছি। সীতাকুণ্ডে যখন কাউকে নমিনেশনের জন্য পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন আমার নেতা তারেক রহমান আমাকে নমিনেশন দিয়েছেন। আমি এর আগে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করেছি। বিজয়ীও হয়েছি। কিন্তু ফ্যাসিস্টরা আমাকে হারিয়েছে তাদের কারচুপির ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। সীতাকুণ্ডের জনগণের ভোটে আমি ইনশাআল্লাহ ধানের শীষে বিপুল ভোটে এমপি হিসেবে জয়লাভ করব। এসময় তিনি সকল নেতাকর্মীকে তার জন্য কাজ করতে বলেন। এসময় তিনি সীতাকুণ্ডকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজমুক্ত উপজেলা হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গিকার করেন।

 

 

 

 

Tags :

সর্বশেষ